ফের বসন্ত

elekhokঅণুগল্পSeptember 27, 2024110 Views

এক মাসের দুধের বাচ্চা কোলে আগলে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দেওয়ালের সাথে ঠে সে বসে আছে রাহেলা। তার দমটুকু যেন যায় যায় অবস্থা। স্থির তার দৃষ্টি। কিছুক্ষণ আগেই খবর এসেছে, তার বর পা লিয়েছে। শুধু একা পালায় নি। এক বিয়াত্তা মেয়ের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। সেই মেয়ের ও একটা ১ বছরের বাচ্চা আছে। সেই বাচ্চা কোলে নিয়ে মেয়ের শাশুড়ি আর বর এসে ঝা মেলা করছে ঘরের উঠোনে। আশপাশ লোকজন ভিড়ে গেছে।
গ্রামে ছিঃ ছিঃ রটে গেছে। রাহেলার শাশুড়ি মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। রাহেলার কানে কোন স্বর ঠেকছে না। মূহূর্তের মধ্যে সে যেন কালা হয়ে গেল। ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। মেয়েটার জন্য রাতে ভালো মতো ঘুম হয় না। এই তো সবে মেয়েটা ঘুমিয়েছিল। ভাবল একটু ঘুমিয়ে নিবে এর মধ্যে এই খবর। ঘৃ ণায় তার শরীর গুলিয়ে আসছে। অভদ্র ভাষায় গালিগালাজ চলছে। তার স্বামী যে অন্য নারীতে আসক্ত এই ব্যাপারটা সে আগে কেন ধরতে পারেনি। কেন পারেনি, সেই আফসোসে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। তাররূপ নেই, রূপবতী নয় সে। কৃষ্ণবর্ণ তার গায়ের রঙ। তাতে কি? বিয়ে তো হয়েছিলো। গরীব ঘরের বাবা ছাড়া এমন কালো রঙের মেয়ের বিয়ে হয়েছিল এই তো ঢের। স্বামীর ভোগ করার পণ্য ছিল সে। কোনদিন স্বামীর মন পাইনি কিন্তু থাকার আশ্রয় তো পাচ্ছিল। স্বামী ভালোবাসে নি তাতে কি? সে তো ভালোবেসেছিলো। তাহলে? তার ভালোবাসার কোন দাম নেই। সে না হয় রূপবতী নয়। কোন রূপ নেই তার। কিন্তু? কিন্তু এই বাচ্চা মেয়েটার রূপ কি কম ছিল। মাশা আল্লাহ! আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছে মেয়েটিকে ফর্সা বানিয়ে। ছেলে হয়নি বলে শাশুড়ি যেভাবে আফসোস করছিলো, মেয়ের রূপ দেখে তখনি সে চুপসে গেল। এই মেয়ের বিয়ে দিতে অসুবিধে হবে না। হোক না,‌বউটা কালি। মেয়ে তো সুন্দর হইছে। এতে আর কি আসে যায়।

ইয়াসমিন হাত পা নড়াচড়া করছে। খিলখিলিয়ে হাসছে। মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুসছে। মেয়েটা কি খুশি। রাহেলার চোখ থেকে টিপ টিপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। হায়রে, তার মেয়ের এমন পো ড়াকপাল না হলেও পারত। এতো কেন খুশি সে? মেয়েকি তার দুঃখ বুঝছে না। তার বাবা প রকিয়া করে এক অন্য নারীর হাত ধরে পালিয়ে গেছে। এ কতোটা অ সম্মানের, কতোটা লা ঞ্ছনার তা কি ওই দুধের শিশু বুঝতে পারে। মেয়েকে বুকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে রাহেলা।

ছোট ইয়াসমিনের জীবনের শুরুটা ভালো যায় নি। বড্ড অবহেলায় মানুষ হলো সে। সাত বছর বয়স অবধি বুঝল না, যেই মানুষটিকে সে বাবা ডাকে সে তার আসল বাবা নয়। সৎ বাবা! ছোট এক ভাই হওয়াতে বাবার চোখে মুখে যেই খুশির চিহ্ন দেখতে এতোটা খুশি বাবা কখনো তাকে দেখে হয় নি। কেন হয়নি? সৎ বাবা মানে কি? বাবা তো বাবাই হয়। সৎ আর আবার আসল বাবা কি হয়, সেই কথা ছোট্ট ইয়াসমিনের মস্তিষ্কে ঢুকল না।

একদিন সে বুঝতে পারল, সৎ বাবা আর আসল বাবার মাঝে তফাৎ। বয়স তখন ১২। ছোট ইয়াসমিন বড় হতে হতে বেশ রূপবতী হতে লাগল। রূপের প্রশংসা তার এলাকা জুড়ে। সেই রূপ চোখে পড়ল তার উপরও। সৎ বাবার কাছে শ্লী লতাহানির শিকার হলো সে। তখন বুঝতে পারল, আসল বাবা কখনোই বোধহয় তার সাথে এমন করতে পারতো না। কখনো না! মেয়েদের কাছে তো বাবাই সব। ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠল ইয়াসমিন। তার কান্নার শব্দ ঘরের বাইরে গিয়ে ঠেকতে পারল না। মা মুখ চেপে ধরল। বাবা তো সৎ ছিল কিন্তু মা! মা তো আসল মা। তারই মা। এই মাও অন্যায় করল তার সাথে। সুবিচার ছিলো না তার ভাগ্যে। চড় মেরে চুপসে দিল তাকে। দোষারোপ তার উপরই চলছিলো। তার চলাফেরা ঠিক ছিল না। এতো বড় মেয়ে ঠিক মতো চলতেও জানে না। তা চ্ছিল্যের স্বর! তার কোন মূল্য নেই কারো কাছে। নিজের মায়ের কাছেই তো নেই। এতোটুকু বয়সেই পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত বিষয়টি তার চোখে পড়ল। বিভী ষিকাময় ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল সে।

এই মেয়েকে তো আর বাড়ি রাখা যায় না। ফেরতে হলো নানীর কাছে। একমাত্র মা আর নানীই তো ছিল তার জীবনে। নানী তাকে পর করেনি। আগলে নিয়েছিল। বুড়ির জীবনে শেষ বয়সেই এই মেয়েই শেষ অবলম্বন হলো। পড়াশোনার ধারের কাছেও পাঠানো হয়নি তাকে। কিছুই পারে না সে। বুড়ো নানী আর নাতনী মিলে থাকবে কি করে? অবশেষে পৌষের আগমন ঘটলো। পিঠা বিক্রি করে তাদের সংসার চলতে লাগল। শুধু পৌষ, মাঘ না। সারাবছর ধরেই পথের ধারে পিঠে বিক্রি করত তারা!

ইয়াসমিন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল। তার বয়স তখন ১৭। পুরনো অতীত ভুলে থাকার চেষ্টা তো সে করছিলো। কিন্তু কোন পুরুষকে তার জীবনে জায়গা দেবার চিন্তা সে মাথাতেও আনে নি। কিন্তু এমন রূপবতী মেয়ে দিনের পর দিন ঘরে বসিয়ে রাখলে তো হয় না। লোকের ন জরে পড়বে। তার বিয়ে দিতে হয়।

বিয়ে নিয়ে সত্যিই কোন সমস্যা হলো না। হবার ও ছিল না। ইয়াসমিনের মতো মেয়ের বিয়ে নিয়ে কাউকে চিন্তে করতে হয়নি। খুব ভালো, সচ্ছল পরিবার দেখেই তাকে বিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু পরিবার ভালো, সচ্ছল মানেই কি পরিবারের সবাই ভালো। নিজেকে সংকুচিত করে নিল সে। জীবনের অন্ধকার দিকগুলোর সাথে পরিচিতি ছিল সে। কাছের মানুষগুলোর সবচেয়ে ঘৃ ণ্য রূপ সে দেখেছে। এরপর সত্যিই কি কাউকে বিশ্বাস করা যায়।

বাসর ঘরে প্রথমবার সামনাসামনি দেখল তার স্বামীকে। এর আগে শুধু ফোনের স্ক্রিনেই দেখা। সামনাসামনি তাকে দেখামাত্র তার বুক কেঁপে উঠলো। কাঁপছে সেও। শীতের এই মৌসুমে ঘেমে একাকার মেয়েটা। সেইরাতের কুৎসিত ঘটনা যেন তার চোখের সামনে বিচরিত হচ্ছিল।

প্রবাসী ইরহান শিকদার থমকে গেল। তার বউ সত্যিই খুব রূপবতী। ফটোতে দেখেছিলো শুধু কয়েকবার এছাড়া তার সাথেও সামনাসামনি দেখা হয়নি। শুধুমাত্র বাবা অসুস্থ বলে আর খুব জলদি বিদেশ ফিরতে হবে বলেই তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলেছে সে। হাতে মাত্র ২ মাস। এই ২ মাসেই কি বিবাহিতা স্ত্রীর মন জয় করতে পারবে সে। দুই অপরিচিত মানুষ একে অপরকে দেখছে। মেয়েটা কাঁদছে! কেন কাঁদছে? প্রিয়জন কে ছেড়ে আসার বেদনায়। এই মেয়েকে সে কি নিজের করতে পারবে? পারবে কি তার মনে নিজের জন্য জায়গা করে নিতে? পানির গ্লাস সামনে এগিয়ে দিল। ভয়ে কেঁপে উঠলো মেয়েটা। বিস্মিত তার দৃষ্টি। ইরহান শিকদার মলিন কণ্ঠে বলল, “পানি খেয়ে নাও। আর কেঁদো না প্লিজ। তোমার নানীর জন্য কি তোমার মন খারাপ করছে। কাল সকালেই দেখতে পারবে। যখন ইচ্ছে হয় তখন চলে যাবে। কেউ কিছু বলবে না। তুমি প্লিজ মন খারাপ করো না।”

ইয়াসমিন চুপসে গেল। তার অবাক দৃষ্টি পড়ে রইল লোকটার দিকে। লোক কেন বলছে? এ তো তার স্বামী। তার স্বামীর কণ্ঠস্বর তাকে যেন স্বাভাবিক করে তুলল। ইশ, কি সুন্দর করে কথা বলে লোকটা। কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাস হাতে নিল। ইরহান শিকদার জিজ্ঞেস করল, “আমি কি এখানে বসতে পারি?”

ইয়াসমিন চোখ তুলে তাকাল। ইরহান শিকদার মিষ্টি করে হেসে বসে পড়ল। ইয়াসমিন পানির গ্লাসে চুমুক দিল। তার মনের অস্থিরতা এখনো কমেনি। তার স্বামী অদ্ভুত ভাবে তাকে দেখছে। মনে হচ্ছে সে যেন কোন ননীর পুতুল। এমন পুতুল কখনো দেখেনি সে। আচমকা জিজ্ঞেস করল, ”তোমার কি খাওয়া হয়েছে?”

চমকে তাকাল ইয়াসমিন। মনে হলো এমন কথা যেন সে জীবনে শুনেনি। কখনো এমন আদুরে স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করেনি “খেয়েছো?” মাথা দুলিয়ে না করল সে। ইরহান শিকদার মুচকি হেসে উঠে চলে গেল। ভাবনায় পড়ে গেল ইয়াসমিন। লোকটা কোথায় গেল হঠাৎ করে? সে কি করবে? উঠে যাবে এখান থেকে? নাকি বসে রইবে? তাকে তো কিছুই বলে গেলো না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটা ফেরত এলো। হাতে একটা থালা। বিরিয়ানি আছে বোধহয়। ঘ্রাণ এখান অবধি চলে এসেছে। ইরহান এগিয়ে এসে তার সামনে বিরিয়ানির প্লেট ধরল। ইয়াসমিনের তর সইল না। দ্রুত হাত বেয়ে নেবার আগেই ইরহান প্লেটটা ফেরত নিয়ে নিল। হকচকিয়ে গেল ইয়াসমিন। ইরহান মুচকি হেসে সামনে বসে পড়ল। শুধালো, “আমি খাইয়ে দেই তোমায়?”

ইয়াসমিনের মুখ দিয়ে কথা বেরুলো না। সে শুনেছিল, “স্বামীর চেয়ে আপন নাকি কেউ হয়না।” তাহলে তার স্বামী কি সত্যিই তার প্রিয়জন হয়ে উঠবে। ইয়াসমিন প্রশ্ন করল না। সেই স্বভাব তার ছিল না। সেও এগিয়ে এসে হা করল। সেও যেন চাইছে, তাদের সম্পর্কটা সুন্দর হোক। ইরহান হাসল। খাইয়ে দিতে লাগল তাকে।

সম্পর্ক কখনো একজনের চেষ্টায় আগায় না। দুজন মিলে চেষ্টা করতে হয়। তাহলে সম্পর্ক সুন্দর হয়। ইয়াসমিন আর ইরহান শিকদার দুজনে মিলেই চেষ্টা করছে যেন তাদের সম্পর্ক সহজ হয়।‌ ইয়াসমিনের সাথে তার ভাব করতে বেশিদিন লাগেনি। ইয়াসমিন খুব সহজ সরল। তার অতীতের সমস্ত কথা মুখ ফুটে একদিন বলে দিল ইরহানের কাছে। ফুঁ পিয়ে ফুঁ পিয়ে কাঁদছে সে। সেদিন প্রথমবারের মতো ইরহান জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। স্বামীর বুকে জায়গা পেয়ে যেন সরে যেতে চাইলো না সে নিজেও। আঁকড়ে ধরে রাখল তাকে। কিন্তু সুখ কি বেশিদিন কপালে থাকে। ইরহান কে তো ফিরতে হতো। বিদেশে কাজ করেই তার পরিবারকে চালায় সে। কিন্তু ইয়াসমিন কে ফেলে মোটেও যেতে চাইছিলো না সে। ইয়াসমিন ও যেন ছাড়তে চায় না। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। তার শাশুড়ি কে বেশ ভ য় পায় সে।

অবশেষে ইরহানের চলে যাবার সময় এগিয়ে গেল। কাল বাদে পরশু তার যাবার কথা। আচমকা ঘরে ঢুকে এলেন তার শাশুড়ি। দাঁত কি ড়মিড় করছেন তিনি। ক র্কশ গলায় বলে উঠলেন, “আমার ছেলেরে কি জাদু করছো তুমি মাইয়া? তোমার লইগা ছেলে আমার আর বিদেশ যাইতে চায় না। কই, বিদেশ না গেলে ছেলে খাওয়াইবো কি?”

ইয়াসমিনের মাথায় কোন কথাই ঢুকল না। ইরহান বিদেশ যাবে না। এর মানে কি? সে তো কিছু জানে না। চেঁচামেচি শুনে ইরহান ছুটে এলো। বিরক্তি স্বরে বলল, “আহ মা! কি হচ্ছে কি? বললাম তো চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এরপরেও এতো কথা।”

দু কথা ইয়াসমিন কে শুনাতে পারলেও ছেলের ক্ষেত্রে তা পারলেন না। চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ইয়াসমিন নিঃশব্দে কাঁদছে। ইরহান শিকদার সামনে দাঁড়িয়ে বিরক্তি স্বরে বলল, “তুমি আবার কি শুরু করলে? এই চলে যাবো বলে কেঁদে কেঁদে অস্থির। এখন আর যাচ্ছি না শুনেও কাঁদছো? কি চাও তুমি?”

“আপনি আম্মার মুখের উপর এমন কথা কইলেন? আম্মা কি ভাববো? সব দোষ‌ তো আমার হইবো?”

শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ইয়াসমিন কে। মলিন কণ্ঠে বলে উঠল, “কেউ তোমায় কিছু বলবে না। আমি আছি তো এখানে। তোমার সাথেই থাকব। তোমার জীবনের সকল ইচ্ছা পূরণ করব। তোমার খারাপ সময়ে তোমার পাশে থাকব। এতো কেন ভাবছো? আম্মা এমনই। এই দেখবে রাতে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমায় একটা সত্যি কথা বলি, আম্মাও কিন্তু চান না আমি বাইরে থাকি।”

কথাটা বলেই আচমকা হেসে ফেলল। ইয়াসমিন অশ্রুসিক্ত নয়নে দেখছে ইরহান কে। একটু সাহস জুগিয়ে প্রথমবারের মতো তার ললাটে চুম্বন করল। বলে উঠল, ”আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ শুধু আপনে!”

ইরহান কিঞ্চিত পরিমাণ হাসল। হালকা মৃদু বাতাসে ঘর ছেয়ে যাচ্ছে। পাখির কলকাকলির শব্দ। বসন্ত এসেছে। শুধু এই গ্রামে আসেনি, তাদের জীবনেও এসেছে!

~সমাপ্ত

0 Votes: 0 Upvotes, 0 Downvotes (0 Points)

Leave a reply

Previous Post

Next Post

Donations

নতুন কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ পেতে এখনই সাবস্ক্রাইব করুন।

I consent to receive newsletter via email. For further information, please review our Privacy Policy

Loading Next Post...
Sign In/Sign Up Search Trending Add a post 0 Cart
Popular Now
Loading

Signing-in 3 seconds...

Signing-up 3 seconds...

Cart
Cart updating

ShopYour cart is currently is empty. You could visit our shop and start shopping.