ডেথ ভ্যাকসিন

অদ্ভুত আগমন

ঢাকার ধানমন্ডির একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রাত তখন ২টা। হাসপাতালের করিডোরে আলো-আঁধারির খেলা, স্টাফরা ক্লান্ত, কিন্তু দায়িত্বের কারণে সক্রিয়। ঠিক তখনই একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে থামে হাসপাতালের মূল দরজার সামনে।

অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো হয় একজন রোগী—৩০-৩৫ বছর বয়সী এক যুবক, যার শরীর প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, চোখের পাতা ভারী, কথাও বলতে পারছে না। নাম—সুমন রহমান।

ডিউটিতে ছিলেন ডা. রায়হান মিয়া, হাসপাতালের ইনফেকশাস ডিজিজ বিভাগের প্রধান। রোগীকে দেখে তাঁর অভিজ্ঞ চোখ বুঝে ফেলল—এটা কোনো সাধারণ জ্বর নয়। শরীরে ভাইটাল সাইন স্থিতিশীল নয়, ব্লাড প্রেসার অস্বাভাবিক কম, এবং হার্ট রেট অতিরিক্ত দ্রুত।

“সাথে কেউ নেই?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে।

“না স্যার, এক লোক রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেল। শুধু এটুকু বলল—এই ছেলেটিকে বাঁচান।”

রায়হান ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। অদ্ভুত… যেন কোনো গোপন বার্তা রয়ে গেছে এই রোগীর শরীরে।

সুমনকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হল। তাঁর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে দ্রুত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হল ল্যাবে। পাশাপাশি একটি পূর্ণ স্ক্যান এবং অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি শুরু করা হলো।

কিছুক্ষণ পর, নার্স সাদিয়া এসে বললেন, “স্যার, রোগীর পকেটে একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে।”

রায়হান ডায়েরিটি হাতে নিয়ে দেখলেন—ময়লা ও কালি লাগানো পাতাগুলোতে কিছু লেখা আছে। অদ্ভুত অক্ষরে, অর্ধেক কোডে, অর্ধেক ডায়াগ্রামে ভর্তি সেই পৃষ্ঠা।

গোপন সংকেত

পরদিন সকালে ডা. রায়হান ডায়েরিটি নিয়ে যান তাঁর পুরনো বন্ধু ও গবেষণাকারী ড. তানজিন ইসরাত-এর কাছে। তানজিন একজন জীববিজ্ঞানী ও সাইবার ক্রিপ্টোলজিস্ট। তিনি সরকারি ও আন্তর্জাতিক কিছু জৈব-সন্ত্রাস বিরোধী প্রকল্পে কাজ করেছেন।

ডায়েরির পৃষ্ঠা দেখে তানজিন বললেন, “এই সংকেতগুলো আমি আগে কোথাও দেখেছি… এটি একটি গবেষণাগারভিত্তিক কোডিং। ভাইরাস স্ট্রেইন, মিউটেশন চক্র, ও প্রতিরোধ গঠন—সব এখানে লুকানো।”

রায়হান চিন্তিত গলায় বললেন, “তুমি কী বোঝাতে চাইছ?”

“সোজা ভাষায়, কেউ একজন একটি কৃত্রিম ভাইরাস তৈরি করেছে। সেটা হয়তো পরীক্ষামূলকভাবে কাউকে সংক্রমিত করেছে, আর সেই কাউকেই তুমি গতরাতে হাসপাতালে পেয়েছ।”

অচেনা জীবাণু

ল্যাব রিপোর্ট এসে গেল। সুমনের রক্তে একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রোটিন-চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার কোষে অদ্ভুত রকমের কোষ ক্ষয় দেখা যাচ্ছে। হিমোগ্লোবিন মাত্রা হঠাৎ করে কমে যাচ্ছে, কিন্তু কোথাও বাহ্যিক রক্তপাত নেই।

ডা. রায়হান মেডিকেল বোর্ড গঠন করলেন। তাতে ছিলেন:

  • ডা. তানজিন – বায়োকেমিস্ট ও ক্রিপ্টোলজিস্ট
  • ডা. আরাফাত – ভাইরোলজিস্ট
  • ডা. সাবিহা – ইমিউনোলজিস্ট

তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন: “এই রোগটি মানবদেহের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়, কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে, এবং ধীরে ধীরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল করে দেয়।”

তানজিন এরই মধ্যে ডায়েরি বিশ্লেষণ করে আরও একটি বিষয় বুঝলেন—এই ভাইরাসটি এমনভাবে ডিজাইন করা, যাতে এটি সহজে ধরা না পড়ে। মানে, সাধারণ পরীক্ষায় ধরা পড়বে না, কিন্তু শরীরের ভেতর ধ্বংসের খেলা চলবে।

মৃতের শহর

সুমনের ঠিকানা অনুযায়ী তাঁরা তদন্তে বের হলেন। ছোট্ট একটি শহর—মেহেরপুর জেলার গোপন গ্রাম, যেখানে সাম্প্রতিক সময়ে ৮ জন হঠাৎ মারা গেছে বলে জানা যায়।

ডা. রায়হান এবং তানজিন সেখানে পৌঁছে দেখলেন, গ্রামের কিছু মানুষ অদ্ভুতভাবে অসুস্থ। কেউ গলাব্যথা, কেউ জ্বর, কারো আবার শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তারা জানতে পারলেন, কিছুদিন আগে অচেনা এক গবেষক দল এসেছিল—যারা বলেছিল তারা পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করছে।

আসলে তারা করছিল জীবাণু পরীক্ষা। সেই জায়গায়ই তৈরি হচ্ছিল সেই ভাইরাস, আর স্থানীয় মানুষকে বানানো হচ্ছিল ‘টেস্ট সাবজেক্ট’।

শত্রু চিহ্নিত

তানজিন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানালেন।

“এই ভাইরাস তৈরি করেছে A.C.R. — এক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, যারা মানবজাতির বিরুদ্ধে জৈব-অস্ত্র বানায়। তাদের উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা ও ভয় ছড়ানো।”

তারা আবারও ফিরলেন ঢাকায়, কারণ রোগী সুমনের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তাঁরা বুঝলেন, এখন সময় খুব কম। A.C.R. হয়তো বুঝে গেছে তাদের গোপন টেস্ট সাবজেক্ট (সুমন) তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। তারা এখন তাকে হত্যা করতে পারে, অথবা হাসপাতালেই হামলা চালাতে পারে।

হাসপাতালের ভিতরে শত্রু

ডা. রায়হান সিদ্ধান্ত নিলেন হাসপাতালের নিরাপত্তা বাড়ানোর। কিন্তু একজন কর্মীর গতিবিধি তাদের চোখে পড়ল—নিরাপত্তা গার্ড রফিক প্রায়ই ফোনে কোথায় কথা বলেন, মাঝেমধ্যে অদৃশ্য হয়ে যান।

তানজিন একদিন তাকে ফলো করলেন। দেখলেন সে হাসপাতালের ল্যাব থেকে ছবি তুলে বাইরে পাঠাচ্ছে। ধরা পড়ে গেলে সে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করল—

“ওরা আমার বোনকে অপহরণ করেছে। আমাকে বলেছে, যতক্ষণ তথ্য দিচ্ছি, ততক্ষণ সে নিরাপদ।”

রফিককে দিয়ে পরিকল্পনা বদলানো হল। তাকে ব্যবহার করে উল্টো ফাঁদ পাতল রায়হান ও তানজিন।

ভ্যাকসিনের জন্য দৌড়

ডায়েরির সূত্র ধরেই তারা তৈরি করলেন একটি সম্ভাব্য প্রোটিন-ব্লকার। এটি ভাইরাসের কোষে ঢুকে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। কিন্তু আগে এটি পরীক্ষা করা দরকার ছিল।

সুমনের শরীরের কোষ থেকেই তারা তৈরি করলেন অ্যান্টিবডি। একটি এক্সপেরিমেন্টাল ভ্যাকসিন বানালেন, নাম দিলেন ‘RVX-17’।

রায়হান বললেন, “সময় নেই, এখনই দিতে হবে।”

সবার মত নিয়ে RVX-17 ইনজেকশন দেওয়া হল সুমনের শরীরে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে সংজ্ঞা হারাল, তার হার্ট রেট কমে গেল। ঘন্টা দুয়েক নিঃশ্বাস বন্ধের মতো অবস্থা, কিন্তু তারপর…

হঠাৎ মনিটরে শব্দ বাজে—বিপ… বিপ… বিপ…

সে বেঁচে আছে!

ধ্বংস ও নতুন ভোর

সুমনের সুস্থতার খবর পৌঁছাল সরকারের উচ্চপর্যায়ে। গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশেষ বাহিনী অভিযান চালিয়ে A.C.R. এর বাংলাদেশ শাখার মূল ঘাঁটি ধ্বংস করে। কিছু বিজ্ঞানী আটক হয়, কিছু গা ঢাকা দেয়।

রায়হান ও তানজিন সরকারি স্বীকৃতি পান—’জৈব-সন্ত্রাস প্রতিরোধে বিশেষ অবদান’ হিসেবে। RVX-17 এখন জাতিসংঘের অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি অ্যান্টিভাইরাল গবেষণার মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

তারা জানতেন, যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। ভাইরাস রূপ বদলাতে পারে, শত্রু আবার আসতে পারে। কিন্তু তারা প্রস্তুত। এইবার চিকিৎসা শুধু রোগ সারানোর নাম নয়, মানবতা রক্ষার শেষ দুর্গ।

শেষ।

0 Votes: 0 Upvotes, 0 Downvotes (0 Points)

Leave a reply

Previous Post

Next Post

Donations

নতুন কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ পেতে এখনই সাবস্ক্রাইব করুন।

I consent to receive newsletter via email. For further information, please review our Privacy Policy

Loading Next Post...
Sign In/Sign Up Search Trending Add a post 0 Cart
Popular Now
Loading

Signing-in 3 seconds...

Signing-up 3 seconds...

Cart
Cart updating

ShopYour cart is currently is empty. You could visit our shop and start shopping.