চিত্ররহস্য

১. অদ্ভুত কল
রাত ৯টা।
ডিটেকটিভ সোহেল রহমান তখন বাসায় বসে পুরনো কেস ফাইল পড়ছিলেন।
এমন সময় ফোন বাজল।

– “স্যার, শিল্পী অনিমেষ ঘোষ আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু দেয়ালে আঁকা শেষ ছবিটা… কিছু ঠিকঠাক লাগছে না।”

সোহেল থমকে গেলেন।
“ছবিটা বলছে কিছু?”
– “হ্যাঁ স্যার। ছবির নাম – ‘জ্যান্ত খুনি’। আর তার নিচে রক্ত দিয়ে লেখা – “তাকে খুঁজে বের করো।”

২. ঘটনাস্থল
ঢাকার পুরান অংশের একটা ভাঙাচোরা বাড়ি। বাড়ির এক কোণায় মিলল অনিমেষ ঘোষের ঝুলন্ত দেহ। দেয়ালে বিশাল এক অদ্ভুত চিত্র—একটি মুখ, কিন্তু চোখ নেই, নাক নেই—শুধু ঠোঁটে আঁকা কৌতুকের হাসি।

নীচে সেই ভয়ংকর লাল হস্তাক্ষর:

“তাকে খুঁজে বের করো”

সোহেল ফিসফিস করে বললেন,
“শিল্পীরা কখনোই শুধু ছবি আঁকে না, তারা সত্য লুকিয়ে রাখে রঙে।”

৩. সন্দেহের বৃত্ত
অনিমেষ ঘোষের নিকটজনদের মধ্যে তিনজনকে শনাক্ত করা হয়:

  1. রেশমা – তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা, যার সঙ্গে সম্প্রতি ঝগড়া হয়েছিল।
  2. তানভীর – প্রতিদ্বন্দ্বী চিত্রশিল্পী, যে বারবার তাঁর কাজ নকল করত।
  3. রিজওয়ান – এক ধনী সংগ্রাহক, যিনি অনিমেষকে অনেক টাকার প্রস্তাব দিয়েও ‘জ্যান্ত খুনি’ ছবিটি কিনতে পারেননি।

তিনজনই হত্যার কারণ হতে পারে। কিন্তু প্রমাণ কোথায়?

৪. ছবির গোপন রহস্য
সোহেল ছবিটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।
আলো নিভিয়ে Ultra-Violet আলো ফেলতেই ছবির এক কোণে ভেসে ওঠে লুকানো এক বাক্য:

“সে আমার আঁকা নয়, সে তো আমার ছায়া।”

ছায়া?
ডিটেকটিভ সোহেল জানতেন, অনেক চিত্রশিল্পী আত্মপ্রতিকৃতিতে নিজেদের অন্তর্জগত দেখায়।
তিনি পুরোনো স্কেচবই ঘেঁটে দেখতে পেলেন — সেই একই মুখ, বারবার ফিরে এসেছে… শুধু চোখের জায়গায় প্রতিবার তানভীরের চশমা-র মতো আকৃতি!

৫. ফাঁদ
সোহেল এক চিত্রপ্রদর্শনীতে তানভীরকে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রদর্শনীতে ঝুলছে ‘জ্যান্ত খুনি’ ছবির হুবহু নকল কপি।

তানভীর থেমে গেল, বলল:
– “কে বানাল এই নকল? এটা তো অনিমেষ নিজেই শেষ করেনি।”

সোহেল হাসলেন।
– “তাই তো বলছি, তুমি তো জানার কথা নয়, যদি না তুমি নিজেই আঁকাটা শেষ করে তাকে শেষ করে দাও।”

৬. পরিণতি
তানভীর মুখ নিচু করে বলল:
– “সে আমার প্রতিভা চুরি করেছিল… আমি শুধু নিজের কাজটা ফিরিয়ে এনেছি।”

ডিটেকটিভ সোহেল টুকে নিলেন:

“ছবি সবসময় কথা বলে না, কিছু ছবি শুধু অপেক্ষা করে সঠিক চোখের জন্য।”


পর্ব ২ঃ অদৃশ্য নোটবুক

১. নতুন কেস, পুরোনো ছায়া
“তানভীরের স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা হয়েছে, স্যার।”
সহকারী মিনহাজ রিপোর্ট দিয়ে চলে গেল।

কিন্তু সোহেল রহমানের মাথা ঘুরছে অন্যদিকে।
যখন তানভীরকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সে চুপিচুপি বলেছিল—

“আমি একা ছিলাম না। নোটবুকটা এখনো কারো হাতে আছে…”

নোটবুক?
অনিমেষ ঘোষের শিল্প-ডায়েরি?

২. শিল্পীর ডায়েরি
অনিমেষ ঘোষের পুরোনো স্টুডিও তল্লাশি করতে গিয়ে এক প্রাচীন কাঠের বক্সে পাওয়া গেল কাঁচাভাবে জ্বালিয়ে ফেলা একটি নোটবুকের অংশ।
তাতে আঁকা কয়েকটি মুখ—সবগুলো অর্ধেক জ্বলেছে।
কিন্তু একটায় স্পষ্ট একটি লাইন ছিল:

“আমি যা দেখেছি, তা কেউ বিশ্বাস করবে না। ওরা ছবির ভেতর বাস করে। ওদের নেতা হচ্ছে ‘বাক্যহীন মুখ’।”

৩. নতুন খুন
এর ঠিক ২ দিন পর, আরেক শিল্পী রেজওয়ান হক তার গ্যালারিতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলেন।
মৃতদেহের পাশে রক্তে আঁকা একটি মুখ। ঠিক একই রকম — চোখ ছাড়া, ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি।

দেয়ালে লেখা ছিল:

“আমরা একে একে আসছি।”

ডিটেকটিভ সোহেল বুঝলেন—তানভীর সত্য বলেছিল।
এটা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নয়, এটা একটা সিরিয়াল ক্রাইম।

৪. অদৃশ্য নোটবুক
নতুন তথ্য মিলল:
একজন তরুণ চিত্রশিল্পী, নাম মিজান সিদ্দিকী, সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন—
“এক শিল্পীর পুরোনো নোটবুকের ছায়া এখন আমার ক্যানভাসে এসে বসেছে। আমি এখন যা আঁকি, তা রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।”

সেই রাতেই মিজান নিখোঁজ।

৫. মুখোমুখি
সোহেল এক পুরাতন ট্রাম কারখানায় গিয়ে মিজানকে খুঁজে পান।
সে আঁকছে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষের মুখ — সবাই চোখহীন, ঠোঁটে হাসি, যেন কাঁদছে হাসিমুখে।

সোহেল ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলে—
– “এই মুখের মানে কী?”

মিজান চুপচাপ বলল—
– “এই ছবিগুলো আমি আঁকিনি।
আমার হাত নড়লেও, ইচ্ছাটা আমার নয়।”

তার চোখ লাল, জ্বরগ্রস্ত।
– “সেই নোটবুক… ওটা একটা ফাঁদ ছিল। আমি এখন ওদের দেখছি… কিন্তু আপনি জানেন না, তারা এখন আপনাকেও দেখছে।”

৬. চূড়ান্ত উক্তি
স্টুডিওর দেয়ালে অজানা হাতে আঁকা চিঠি:

“তুমি যত গভীরে দেখবে, আমরাও তত গভীর হয়ে উঠব।
তোমার চোখেই একদিন আমাদের জন্ম হবে।”

সোহেল রহমান হঠাৎ বুঝলেন—এখানে শুধু খুনি নেই, আছে একটি দর্শন, এক ভয়ংকর ভাবনা, যেটা এখন ক্যানভাস ছাড়িয়ে মানুষের মন দখল করছে।


পর্ব ৩ঃ বাক্যহীন মুখ

১. মুখ, যার শব্দ নেই
ডিটেক্টিভ সোহেল রহমান আজকাল ঘুমাতে পারছেন না।
কারণ, যে মুখটি ছবিতে বারবার ফিরে আসে, এখন স্বপ্নেও তাকে তাড়া করে।

একদিন রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলেন… ঘরের দেয়ালে কার্বন পেনসিলে আঁকা সেই মুখ।

তাঁর হাতে আঁকা নয়।

তিনি বাসায় একা।

২. রহস্যময় সংগঠন
অনুসন্ধানে জানা গেল, শিল্পীমহলের নিচে একটি গোপন সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল—“বাক্যহীন মুখ”।

এরা বিশ্বাস করে:

“চোখ সব কিছু দেখে না, আর মুখ সব কিছু বলে না। সত্য লুকিয়ে থাকে নিঃশব্দ শিল্পে।”

এই সংগঠনের নিয়ম:
যারা একবার “মুখ” আঁকে, তারা জীবনে আর কখনো মুখ খুলে সত্য বলতে পারে না।
শুধু ছবি আঁকতে থাকে… যতক্ষণ না মারা যায়।

৩. একমাত্র সাক্ষী
সোহেল খুঁজে পান একমাত্র জীবিত সদস্য – ছায়া দাস নামে এক সাবেক শিল্পী, যিনি এখন মানসিক হাসপাতালে।

তিনি বলেন:

– “ওরা আমার হাত দিয়ে ওদের মুখ আঁকাত।
আমি থামতে চেয়েছিলাম। ওরা আমার কণ্ঠ নিয়ে নিয়েছে…
এখন আমি শুধু কাঁদতে পারি। কাঁদলে হাসির শব্দ হয়…”

তার ঘরের দেয়ালে শুধু একটাই লাইন বারবার লেখা:

“তাকিয়ে থাকলে সে তোমাকেও আঁকবে।”

৪. গোপন চিত্রশালা
সোহেল একটি নির্জন জায়গায় পৌঁছান — পুরনো ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত এক পরিত্যক্ত চিত্রশালা।

সেখানে ১৭টি ক্যানভাস ঝুলে আছে। প্রতিটি ছবিতে একেকজন খুন হওয়া ব্যক্তির মুখ।
সবচেয়ে বড় ছবিটিতে সোহেল নিজের মুখ দেখেন।
কিন্তু তার চোখ অন্ধকার, ঠোঁটে সেই একই হাসি।

কোণায় রাখা চিঠিতে লেখা:

“তুমি অনেক ভালো পর্যবেক্ষক, সোহেল। এখন শুধু একটা রঙ লাগবে—
তোমার রক্ত।”

৫. শেষ দৃশ্য
সোহেল বের হওয়ার সময় পেছনে দাঁড়িয়ে এক শিশু বলল,
– “তোমার চোখে এখন সত্য আছে। এখন তুমি কি করবে?”

সে হাসে।

কিন্তু সেই হাসি সোহেলের নিজের মুখে ফিরে আসে।
সে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখে, তার ঠোঁট দুটো ধীরে ধীরে সেই অদ্ভুত বাঁক নিচ্ছে…

……………

সোহেল বুঝতে পারলেন, কিছু সত্য এত গভীর ও জটিল যে তা একা বোঝা বা মাপা যায় না।
মানুষের মনের অন্ধকার ও শিল্পের রহস্যের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম রেখা টেনে রেখেছিল ‘বাক্যহীন মুখ’।
এই রহস্যভেদ তার জীবনের এক অন্য অধ্যায়ের সূচনা, কিন্তু সে নিজেই সেই গল্পের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন।

সত্যকে চেনা মানে কখনো কখনো নিজের ভয়কে স্বীকার করা। আর সব থেকে বড় সাহস—সে ভয়কে জয় করা।

1 Votes: 1 Upvotes, 0 Downvotes (1 Points)

Leave a reply

Previous Post

Next Post

Donations

নতুন কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ পেতে এখনই সাবস্ক্রাইব করুন।

I consent to receive newsletter via email. For further information, please review our Privacy Policy

Loading Next Post...
Sign In/Sign Up Search Trending Add a post 0 Cart
Popular Now
Loading

Signing-in 3 seconds...

Signing-up 3 seconds...

Cart
Cart updating

ShopYour cart is currently is empty. You could visit our shop and start shopping.